গর্ভবতী ও প্রসূতি মায়ের যত্ন
কথায় বলে ‘শিশুর হাসিতে মায়ের খুশি’। আর এই হাসি দেখতে হলে মাকে গর্ভকাল থেকেই থাকতে হবে হাসিখুশি ও দুশ্চিন্তামুক্ত। গর্ভবতী মাকে নিয়মিত ঘুম ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। সর্বোপরি সুস্থ শিশুলাভের জন্য গর্ভবতী মায়ের পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রয়োজন। পরিবারের সবারই গর্ভবতী মাকে এ ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতা করা উচিত।
গর্ভবতী মায়ের নিজের প্রয়োজনীয় খাবার খাওয়ার পাশাপাশি গর্ভস্থ শিশুর জন্য বাড়তি খাদ্যের প্রয়োজন হয়। তাই গর্ভবতী মা ও তার অনাগত শিশুর সুস্থ জীবনের জন্য গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিন পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা প্রয়োজন। অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও দারিদ্র্যের কারণে আমাদের দেশের অনেক গর্ভবতী মা প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করেন না। মায়ের অপুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ শুধু তার জন্যই ক্ষতিকর নয়, ভ্রুণ এবং নবজাত শিশুর জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। গর্ভাবস্থায় মা পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ না করার কারণে শিশু ও গর্ভবতী মা উভয়ই অপুষ্টিতে ভোগেন।
আর মা যদি গর্ভাবস্থায় অপুষ্টিতে ভোগেন তাহলে যে শিশু জন্মগ্রহণ করবে তার জন্ম-ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হবে, শিশু জন্মগতভাবেই অপুষ্টি নিয়ে জন্মগ্রহণ করবে। এ ধরনের শিশুর মৃত্যুঝুঁকিও বেশি থাকে। পক্ষান্তরে গর্ভকালীন সময়ে মা যদি পুষ্টিকর খাদ্য না খান, তাহলে মায়ের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়বে। এ ধরনের মায়েদের গর্ভপাত, অপরিণত ও মৃতশিশু প্রসব এবং প্রসবকালীন মৃত্যুর ঝুঁকিও বেশি থাকে।
গর্ভবতী মায়েদের প্রতিদিন ভাত, মাছ (মলা, ঢেলা ইত্যাদি ছোট মাছ), সম্ভব হলে মাংস, ডিম, দুধ এবং ঘন ডাল, সিমের বিচি প্রভৃতি খেতে হবে। এছাড়া গাঢ় সবুজ ও হলুদ রঙের শাকসবজি ও তাজা ফলমূল, বিশেষত পাকা আম, পেঁপে, কাঁঠাল, পেয়ারা, আনারস, কচুশাক, পুঁইশাক, ডাঁটাশাক, লালশাক, গাজর, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া এসব ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খাওয়া উচিত। কারণ ভিটামিন ‘এ’ শরীরে আয়রন (লৌহ) ব্যবহারে সাহায্য করে। আমলকি, পেয়ারা, বাতাবিলেবু, কামরাঙা, পাতি লেবু, কাগজী লেবু, কুল ইত্যাদি খেলে সহজেই ভিটামিন ‘সি’-র অভাব পূরণ হবে। শরীরে আয়রন (লৌহ) শোষিত হওয়ার জন্য ভিটামিন ‘সি’ অত্যন্ত জরুরি। গর্ভবতী মায়েদের জন্য ক্যালসিয়ামও গুরুত্বপূর্ণ।
ক্যালসিয়ামের অভাবে উচ্চ রক্তচাপ, প্রি-একলাম্পশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দুধ, ঘি, মাখন, ডিমের কুসুম, ছোট মাছ (কাঁটাসহ) কলিজা, ডাল, মাংস এবং সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল ইত্যাদিতে প্রচুর ক্যালসিয়াম থাকে। কোনো কারণে সব ধরনের পুষ্টিকর খাবার জোগাড় করা সম্ভব না হলেও বাড়িতে তৈরি স্বাভাবিক খাবার যেমন- একটু বেশি ভাত, বেশি পরিমাণ ঘন ডাল, তরকারি এবং পর্যাপ্ত ফলমূল খেলে এই প্রয়োজন মিটবে।
গর্ভাবস্থায় মাকে লৌহসমৃদ্ধ খাবার (যেমন- মাংস, ডিম, কলিজা, ডাল, কাঁচাকলা, কচুশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, পুঁইশাক) এবং অন্যান্য সবুজ শাকসবজি ও টাটকা ফলমূল প্রতিদিন বেশি করে খেতে হবে। গর্ভবতী মায়ের খাদ্যে আয়োডিনযুক্ত লবণ এবং সামুদ্রিক মাছ ও সামুদ্রিক মাছের তেল থাকা উচিত।
প্রচুর শাকসবজি ও তাজা ফলমূল খেলেও আয়োডিনের অভাব পূরণ করা যায়। গর্ভকালীন সময়ে দৈনিক ১৫-২০ গ্লাস বিশুদ্ধ ও আর্সেনিক মুক্ত নিরাপদ পানি পান করা উচিত। এ সময় মায়েদের বারে বারে খেতে হয়।
সন্তান প্রসবের সময় মায়ের শরীরের ওপর অনেক চাপ পড়ে এবং তার দেহের অনেক ক্ষয় হয়। দেহের এ ক্ষয়পূরণ, পুষ্টি সাধন এবং দেহকে সুস্থ-সবল ও নিরোগ রাখার জন্য গর্ভবতী মায়ের মতো প্রসূতি মাকেও বেশি করে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এছাড়া শিশুর জন্মের পরই তার খাবার অর্থাৎ মায়ের দুধ তৈরি হওয়ার জন্য মায়ের অতিরিক্ত পুষ্টির প্রয়োজন হয়। জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধু বুকের দুধ খেতে দিতে হবে।
শিশুর জন্য মায়ের শাল দুধ ও বুকের দুধ পৃথিবীর সেরা পুষ্টিকর খাবার। মায়ের দেহ থেকে বুকের দুধের উপাদান তৈরি হয়। সুতরাং প্রসূতি মায়ের নিজের স্বাস্থ্য রা ও বুকের দুধ তৈরি করার জন্য মাকে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি সমৃদ্ধ সব ধরনের খাবার খেতে হবে।
প্রসূতি মহিলাদের নিজের দেহের ক্ষয়পূরণ ও বুকে দুধ উৎপাদনের জন্য প্রোটিনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। এজন্য প্রসূতি মাকে প্রতিদিন প্রোটিন জাতীয় খাবার যথা-মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল ইত্যাদি বেশি করে খেতে হবে।
সাধারণত প্রসূতি মায়ের বুকে দৈনিক ২০-৩০ আউন্স দুধ তৈরি হয়। ২ গ্রাম খাদ্য প্রোটিন থেকে ১ গ্রাম দুধের প্রোটিন তৈরি হয়। এটি তখনই সম্ভব মায়েরা যদি দৈনিক ১০০ গ্রাম প্রোটিনের মধ্যে কমপে অর্ধেক বা দু-তৃতীয়াংশ প্রাণিজ প্রোটিন যেমন- মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি গ্রহণ করেন। প্রাণিজ প্রোটিন মায়ের দুধের উৎকৃষ্ট উপাদান।
শিশুর শরীর বৃদ্ধি শিশুকালই সবেচেয়ে বেশি হয়। এজন্য প্রচুর প্রোটিন প্রয়োজন। আর এ প্রোটিন শিশু মায়ের বুকের দুধ থেকেই পেয়ে থাকে। ক্যালসিয়াম ও লৌহজাতীয় খাবারও প্রসূতি মাকে বেশি করে খেতে হবে, যাতে দুধের মাধ্যমে এ দুটি উপাদান শিশুর দেহের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণের জন্য প্রসূতি মাকে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। আর লৌহের চাহিদা পূরনের জন্য মার লৌহসমৃদ্ধ খাবার বেশি করে খাওয়া উচিত। স্তন দানকালে মায়ের প্রথম ছয় মাস অতিরিক্ত ক্যালরি প্রয়োজন। এ ক্যালরি দুধ তৈরি ও নিঃসৃত করার কাজে ব্যয় হয়। সেজন্য বেশি করে ভাত, রুটি ইত্যাদি খাওয়া উচিত। তাছাড়া ভিটামিন ‘এ’, ‘বি-১’ (থায়ামিন), বি-২ (রাইবোফেবিন) এবং ভিটামিন ‘সি’র চাহিদা পূরণের জন্য প্রসূতি মাকে প্রতিদিন চাহিদার অতিরক্তি শাক-সবজি ও মৌসুমী ফলমূল খেতে হবে।
প্রসূতি মা যখন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান, তখন তার শরীর থেকে প্রতিদিন অনেক পানি বের হয়ে যায়। এ ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য তাকে প্রচুর পানি পান করতে হবে, তাহলে দুধের প্রবাহ সহজ হয়। এছাড়া রসালো ফলমূল এবং বেশি করে ঝোল দিয়ে রান্না করা মাছের তরকারিও বেশ উপকারী।
বাচ্চা প্রতিদিন যে পরিমাণে মায়ের দুধ খায় অন্তত সেই পরিমাণ পানি জাতীয় খাবার প্রসূতি মায়ের শরীরে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। শিশু জন্মের পর কমপক্ষে ছয় সপ্তাহ প্রসূতি মাকে ভারী কোনও কাজ করতে দেওয়া যাবে না। এ সময় মা যাতে পরিপূর্ণ বিশ্রাম পান সেদিকে পরিবারের সবার দৃষ্টি দিতে হবে। প্রসূতি মায়ের পরিমিত বিশ্রাম যেমন মায়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে, তেমনি শিশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও সাহায্য করে।