ঘুম কার কত ঘণ্টা প্রয়োজন
ঘুমিয়ে পড়া ও জেগে ওঠা চলে চক্রাকারে। এ দুটি বিষয় ঘুম নিয়ন্ত্রণে একসঙ্গে জুটি বেঁধে উচ্চ কুশলতায় কাজ করে, যার কাজ হলো ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া, আবার ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা। একটি ‘এস’ ও অন্যটি ‘সি’ প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়া ‘এস’ ঘুমের পরিমাণ ও তীব্রতা নির্ধারণ করে। এডিনোসাইনও এ জাতীয় ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী রাসায়নিক পদার্থ, যাদের বলা হয় সমনোজেন। এগুলোর ভারসাম্য পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে ঘুমের বিষয় জড়িত। ২-১২ মাস বয়স ও শিশু বয়সে এসব দ্রুত বাড়ার কারণে শিশু দিনে বেশিণ জেগে থাকতে পারে না, ঘুমে ঢলে পড়ে। প্রক্রিয়া ‘সি’ ২৪ ঘণ্টাব্যাপী ঘুমানোর সময়কাল ও ঘুম-জাগরণের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এর প্রধান ঘড়িটা মগজের ভেনট্রাল হাইপোথ্যালামাস অংশের ‘এসসিএন’ নিউকিয়াসে বসে থেকে হৃদযন্ত্র, রক্ত সরবরাহ তন্ত্র, হরমোন, কিডনি ও ফুসফুসে ছড়ায় এবং এগুলোকে প্রভাবিত ও বশীভূত করে কর্মযজ্ঞ সাজায়। ‘সিকারডিয়ান’ ঘড়ি আসলে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময়ের কাঁটা ধরে সাজানো থাকে। তাই এর মধ্যে থেকে কাজ করার জন্য তাকে প্রাকৃতিক পরিবেশের দ্বারস্থ হতে হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘আলো-আঁধারি’ পরিবেশ।
ঘনঘোর নিদ্রা : গভীর ঘুমের দু’টি সময় আছে, বেলা তিনটা থেকে বিকেল পাঁচটা এবং রাতের শেষ প্রহর তিনটা থেকে ভোর পাঁচটা। তেমনিভাবে সতর্ক জেগে থাকার সবচেয়ে ভালো সময় হলো দুটো, একটা মধ্যদুপুর , অন্যটা বিকেল। অর্থাৎ চোখজুড়ে প্রচণ্ড ঘুমস্রোত নেমে আসার পূর্বণ, যার অন্য নাম ‘দ্বিতীয় ঘুমঝড়’।
ঘুমের নীতিমালা : ঘুমের শারীরবৃত্তের আরেকটা নীতিমালা হলো কম ঘুমের খেসারত সুদ-আসলে মিটিয়ে নেওয়া। ঘুমে ব্যাঘাত জমতে জমতে ঘুমের মূল্যে ঋণ করে চলে দীর্ঘদিন, যা পরবর্তী সময় অবশ্যই ফেরত পেতে চায় স্ব-উদ্যোগে বিভিন্ন পদপে নিয়ে। যেমন, দিবানিদ্রায় কাতর করে দিয়ে, দিনের মনোযোগ বিলুপ্ত করে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও ুদ্র ঘুম ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে। সর্বদা ঘুমে আচ্ছন্নভাব, নিরতিশয় কান্তি, ঘন ঘন হাই ওঠা, বিগড়ানো মেজাজ, হতাশ ভাব, মানসিক অবস্থার সদা পরিবর্তন, ক্রুদ্ধতা, শিরঃপীড়া, মাংশপেশীতে ব্যথা, লেখাপড়ায় খারাপ করা, স্কুলে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়া। এসব উপসর্গ তৈরি হয় ভালোমতো ঘুমাতে না পারায়।
ঘুমের বৈশিষ্ট্য : নবজাতক (০-২ মাস) : নবজাতক ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ১০ থেকে ১৯ ঘণ্টা ঘুমাবে, অপরিণত শিশু খানিকটা বেশি। বুকের দুধ পানের শিশু একনাগাড়ে এক থেকে তিন ঘণ্টা ঘুমায়। অন্যদিকে, ফর্মুলার শিশু দুই থেকে পাঁচ ঘণ্টা একনাগাড়ে ঘুমায়। এক থেকে দুই ঘণ্টা জেগে থাকার বিরতি থাকে মাঝখানে। দিন-রাতে সমান হারে ঘুমায় বিশেষত প্রথম সপ্তাহ। পরে সাধারণত রাতে সাড়ে আট ঘণ্টা এবং দিনে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার মতো ঘুমায়। এ সময়ে বাচ্চার ঘুমানো নিয়ে মা-বাবার ধারণার সঙ্গে পূর্ব পরিচয় না থাকায় অনেক অনুযোগ তৈরি হয়। তবে অতিরিক্ত কান্না, অস্থিরতা, নবজাতকের পেটব্যথা, জি-ই রিফাক্স, ফর্মুলা খাবারের প্রতিক্রিয়ায় ঘুম নাও হতে পারে। শিশুকে ঘুমের সময় যেন পিঠের ওপর শোয়ানো হয়, শক্ত ম্যাট্রেসে ও নরম বিছানায় নয়। বালিশ বা কমফোর্টারস ব্যবহার নিষেধ। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশুর বুক ও মাথা ঢাকা না থাকে।
কোলের শিশু (২-১২ মাস) : মোট ঘুমের পরিমাণ ২৪ ঘণ্টায় ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টার মতো। রাতে নয় থেকে ১০ ঘণ্টা এবং দিনে তিন-চার ঘণ্টার মতো। ঘুমে হাত-পা কামড়ানো, মাথা দোলানো-এ সব ভালো ঘুম না হওয়ার উপসর্গ বলে স্বীকৃত। ছয় সপ্তাহ থেকে তিন মাস বয়সের শিশু ঘুমের ব্যাপ্তি দখলে নিতে পারে।
টলটলিয়ে হাঁটতে পারা শিশু (১-৩ বছর) : মোট দৈনিক ঘুম ১১ থেকে ১৩ ঘণ্টা। দিনের বেলায় দুবারের ঘুমের চাহিদা কমে ১৮ মাস বয়সে একবারে পরিণত হয়। অনিদ্রার ছাপ ফুটে ওঠে উপসর্গে। শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশে, ভাষা ও বাকশক্তি অর্জনে সুনিদ্রা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাতে ঘুমের সময় ভয় পায়।
স্কুল-পূর্ব বয়স (৩-৫ বছর) : রাতে নয় থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমায়। দিনে আর নাও ঘুমাতে পারে। অনিদ্রার ফলস্বরূপ ঘুমে হাঁটা, ঘুমাতঙ্ক এসব লণ দেখা যায়। অনিদ্রা রোগ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
শৈশব (৬-১২ বছর) : নয় থেকে ১১ ঘণ্টার দৈনিক ঘুম। ভালো ঘুম না হলে ঘুমে শ্বাসরোধ লণ মেলে। টিভি, কম্পিউটার, ভিডিও গেমস ঘুম হরণের প্রধান কারণ। স্কুল ফলাফলে এর প্রভাব পড়ে।
কৈশর-যৌবন (১২ বছরের বেশি বয়সে) : গড় ঘুম সময় দৈনিক সাত থেকে নয় ঘণ্টা। অনিদ্রার স্বরূপ অতিমাত্রায় ঘুমিয়ে পড়ার প্রবণতা ‘নারকোলেপসিতে’ প্রকাশ পায়। রাতে দেরিতে ঘুমানো, সপ্তাহ শেষে বন্ধের দিনে তা পুষিয়ে নেওয়া-এসব অস্বাভাবিক চিত্র তৈরি হয়। ফলাফল ভালো হয় না।
আরেক ব্যাখ্যায় বলা হয়, বিজ্ঞানীরা ঘুমকে প্রধানত ২টি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমটি ‘নন র্যাপিড আই মুভমেন্ট ঘুম’ এবং দ্বিতীয়টি ‘র্যাপিড আই মুভমেন্ট ঘুম’। নন-রেম ঘুমকে আরো ৪ পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে চোখ জড়িয়ে আসে, ক্রমেই ঘুম হতে থাকে। দ্বিতীয় পর্যায়ে গাঢ় ঘুম হয়। তারপর তৃতীয় গভীর ঘুম, এবং চতুর্থ গভীরতম ঘুম হয়। এভাবে প্রথম ভাগের চারটি স্তর পেরিয়ে পাতায় ঢাকা অেিগালক নড়াচড়া না করলে তাকেই বলে ‘নন-রেম ঘুম’। অপরদিকে এটি যদি দ্রুত নড়াচড়া করে তবে তাকে বলে ‘রেম ঘুম’।
গবেষক ল করেছেন যে, ননরেম নিদ্রার সময় মস্তিষ্ক তরঙ্গ ক্রমে ধীর গতি হয়, ঘুমন্ত মানুষটি স্থির থাকে, অেিগালক নড়াচড়া করে না, শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর গতিতে চলে, অনেকেই এই সময় নাক ডাকতে থাকে। চতুর্থ পর্যায়ে ঘুম গভীরতম হয় এবং তখন বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াকাণ্ডও চলে সবচেয়ে ধীর গতিতে। আবার অন্যদিকে রেম ঘুম সবচেয়ে হালকা। এখানে অেিগালক নড়াচড়া করে শ্বাস-প্রশ্বাসে ছন্দ থাকে, মগজে রক্ত চলাচল বাড়ে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নড়াচড়া করে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই ঘুমের পর্যায়গুলো চলে চক্রাকারে। যেমন, শুরুতেই ননরেম ঘুমের ১ম, ২য়, ৩য় ও চতুর্থ পর্যায় বা ধাপ এভাবে চলে ৯০ মিনিট। এরপর শুরু হয় রেম ঘুম যা ৫Ñ২০ মিনিট মাত্র থাকে। আবার শুরু হয় ৯০ মিনিটের পর্যায়, তারপর ৫Ñ২০ মিনিটের চক্র চলতে থাকে সারা রাত ব্যাপী।
সুস্বাস্থ্যের অধিকারী একজন মানুষ গড়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা ঘুমালে পন্ডিত দেখেছেন যে, এর মধ্যে ৬ ঘণ্টা চলে ননরেম ঘুম এবং ২ ঘণ্টা চলে রেম ঘুম। কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে গবেষকগণ গড়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দিয়েছেন। ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বয়স বাড়ার সাথে সাথে কমতে থাকে এবং ৫০ বছর পর ননরেম ঘুমের ৪র্থ পর্যায় অর্থাৎ গভীরতম ঘুম থেকে অনেকেই বঞ্চিত হন। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। ননরেম ঘুমকে বলা হয় ‘গভীরতম ঘুম’ অথবা ‘স্বপ্নহীন ঘুম’। এ সময় স্বপ্ন থেকে ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ডেকে তোলা সহজ। অপরদিকে রেম ঘুম স্তরে ঘুমটা খুব গভীর হয় না। অথচ এ সময় খুব সহজে ঘুমন্ত ব্যক্তিকে ডেকে তোলা যায় না। এ সময় মানুষ স্বপ্ন দেখে এবং সকাল বেলায় তা মনে থাকে। তাই রেম ঘুমকে বলা হয় ‘স্বপ্নময় ঘুম’।