শিশুর সঠিক খাবার
খাদ্য মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা এবং অধিকার। তবে কোন খাবারের কী গুণ, কোন খাবার কতটুকু খাওয়া উচিত, কোনটা অতি প্রয়োজনীয়, কোনটা নিষিদ্ধ। না জানার ফলে নানারকম ঘাটতি বা বাড়তি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। জন্মের পর থেকে শিশুকে সঠিক ও সুষম খাবারের অভ্যস্ত করতে হবে। কীভাবে বুঝবেন শিশু পর্যাপ্ত দুধ পাচ্ছে শিশু যদি ২৪ ঘণ্টায় ৬ বার প্রস্রাব করে তবে এটা নিশ্চিত যে সে পর্যাপ্ত বুকের দুধ পাচ্ছে। এর ফলে শিশু পরিতৃপ্ত থাকবে এবং ধীরে ধীরে তার ওজন বাড়তে থাকবে। জন্মের পরে প্রথম ১৫/২০ দিন শিশুর ওজন সাধারণত একটু কমে তারপর বাড়তে শুরু করে। শিশু কাঁদলেই যে, সে দুধ পাচ্ছে না এটা মনে করার কোনও কারণ নেই। ছয় মাস থেকে এক বছর বয়সী শিশু ছয় মাসের পর থেকে শুধু মায়ের দুধ শিশুর পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারে না। শিশুর ওজন প্রথম ৬ মাসে জন্ম ওজনের দ্বিগুণ হয়, এক বছরে তিনগুণ এবং দুই বছরে প্রায় চারগুণ হয়। শিশুকে কোনও নতুন খাবার খাওয়ার অভ্যাস করতে হলে অন্তত দুই মাস সময় প্রয়োজন। এসময়ে খুব সহজেই পরিবারের খাবার থেকে তার পুষ্টি চাহিদা মেটে। পরিবারের খাবার অর্থাৎ চাল, ডাল, বিভিন্ন ধরনের সবজি, মাছ, মাংস, সয়াবিন, ফলমূল থেকে শিশুর উপযোগী করে খাবার তৈরি করা যায়। প্রথমে শিশুকে ফলের রস যেমনÑ কমলা, আনার, মালটার রস দিয়ে বাইরের খাবার শুরু করতে হয়। এতে অভ্যস্ত হলে শিশুকে সুজি/চালের গুঁড়ার হালুয়া খাওয়াতে হবে। তারপর আস্তে আস্তে খিচুড়ি শুরু করতে হবে। সাত মাস থেকে খাবারের রুটিন সারাদিনে যতবার সম্ভব বুকের দুধ খাওয়াতে হবে দিনে কমপক্ষে ১ বার ফলের রস অথবা ফল (কলা/কমলা ইত্যাদি) খাওয়াতে হবে। বাচ্চার চাহিদামতো দিনে (দুপুরে ও রাতে) ২বার খিচুড়ি খাওয়াতে হবে। বাচ্চাকে ১/২ বার সুজি/চালের হালুয়া খাওয়াতে হবে।
সাত/আট মাস বয়স থেকে একটু একটু ডিম সিদ্ধ বা পোচ করে খাওয়ানো যাবে। এছাড়া শিশুকে পরিবারের সবার সঙ্গে খাবারের টেবিলে বসাতে হবে এবং পরিবারের রান্না খাবার থেকে একটু একটু খাবার মুখে দিয়ে অভ্যস্ত করতে হবে যাতে এক বছর বয়সের পর থেকে সে পুরোপুরিভাবে সবার জন্য রান্না করা খাবার খেতে পারে। এক থেকে তিন বছরের খাবার শিশুর জন্য দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ সর্বোৎকৃষ্ট দুধ। তাই দুই বছরের পর থেকে তাকে বাইরের দুধ দেয়া যেতে পারে। প্রতিদিন ২-৩ গ্লাস দুধ শিশুর চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনমতো চিনি দিয়ে খাওয়াতে হবে। দুধ ছাড়াও খিচুড়ি, হালুয়া, আটার রুটি, মৌসুমী ফল শিশুর খাবার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং আস্তে আস্তে পরিবারের সবার জন্য রান্না করা খাবারে তাকে অভ্যস্ত করতে হবে। যেমনÑ সকালে নাস্তার টেবিলে পরিবারের সবাই যা খায় সেগুলো তাকে অল্প অল্প করে মুখে দিতে হবে। আবার দুপুরে সবাই যখন খেতে বসবে তখন তা থেকে একটু একটু মুখে দিতে হবে। যাতে সে ধীরে ধীরে বিভিন্ন ধরনের খাবারের স্বাদ গ্রহণ করতে পারে এবং পরিবারের খাবারে অভ্যস্ত হতে পারে। চার থেকে ছয় বছরের খাবার সব শিশুর পুষ্টি চাহিদা একরকম হয় না। ছেলেমেয়ে, শারীরিক গঠন, বয়স ভেদে একই বয়সী শিশুদের মধ্যে পুষ্টি চাহিদা ভিন্ন হতে পারে। যেহেতু শিশুরা চার বছর বয়স থেকে স্কুলে যায়, সেহেতু তাদের টিফিনসহ প্রতিদিনের খাবারের একঘেয়েমি দূর করে খাবারে নতুনত্ব আনতে হবে। প্রতিদিন সকালে আলুভাজি-রুটি না দিয়ে কোন দিন বিভিন্ন ধরনের সবজির মিশ্রণে নিরামিষ ও রুটি, জেলি/জ্যাম দিয়ে রুটি, ডিম দিয়ে রুটি অথবা পাউরুটি টোস্ট করে বা সুজি-দিয়ে রুটি ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের খাবার স্বাস্থ্য সম্মতভাবে বাচ্চাদের খাবার উপযোগী করে পরিবেশন করা যেতে পারে। সাত থেকে নয় বছর বয়সের খাবার এ বয়সের ছেলেমেয়েরা নিয়মিত স্কুলে যায়, খেলাধুলা এবং পড়াশোনা করে। তাই তাদের খাদ্যের চাহিদাও ৪-৫ বছরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে বেশি হয় এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত খাবার একান্ত প্রয়োজন। এ বয়সে বাচ্চাদের বাইরের খাবার অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের চিপ্স, জ্যুস, ফাস্ট ফুড খাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এধরনের প্রবণতা বন্ধ করা উচিত। দোকানে যে সব খাবার পাওয়া যায় সেগুলো বাসায় স্বাস্থ্যসম্মতভাবে তৈরি করা যায়। বাচ্চাদের বুঝাতে হবে যে, বাইরের খাবার খাওয়া শরীরের জন্য ঠিক নয়। শিশুদের কোমল মন, সুতরাং সুন্দর করে বুঝিয়ে বললে তারা বুঝতে পারবে। তাদের খাবার অবশ্যই বৈচিত্র্যময় হতে হবে যাতে তারা খাবার খাওয়ার জন্য আকর্ষণ অনুভব করে। দশ থেকে পনের বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের খাবার শিশুদের বৃদ্ধির প্রক্রিয়া দুই বছর বয়স পর্যন্ত সর্বাপেক্ষা দ্রুত হয়। এরপর বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে আসে এবং আবার ১০-১১ বছর বয়স থেকে বৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। মেয়েদের ১১-১৩ বছর বয়সে এবং ছেলেদের ১৩-১৫ বছর বয়সে এই বৃদ্ধি সর্বাপেক্ষা দ্রুত হয়ে থাকে। এরপর আবার বৃদ্ধির হার কিছুটা কমে যায়। তবে ছেলেমেয়েদের বৃদ্ধির সাধারণ নিয়ম কিছুটা নির্ভর করে বংশগত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা যেমনÑ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, খেলাধুলা, মুক্ত বাতাস ইত্যাদির ওপর। আর বাকিটা নির্ভর করে সুষম ও পর্যাপ্ত খাদ্যের ওপর। বৃদ্ধির হার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের খাবার চাহিদাও বাড়তে থাকে। তাই খাবারের ব্যাপারে বিশেষ যতœবান হতে হবে। শিশু খেতে চায় নাÑ কী করবেন ২-৫ বছর বয়সে পৌঁছে স্বাভাবিক নিয়মে যখন শিশুর খিদে আগের চেয়ে কমে যায় তা অনেক মা-বাবাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তোলে। শিশু যদি ওজনে ও উচ্চতায় ঠিক থাকে, স্বাভাবিকভাবে বাড়ে, তবে খাবার সে প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করছেÑ কথাটি জানিয়ে এসময় মা-বাবাকে আশ্বস্ত করতে হবে। মা-বাবার উচিত এনিয়ে অহেতুক মাথা না ঘামানো। বরং শিশুর বয়স বিবেচনায় রেখে খাবার সময়ের অন্তর, স্থান ইত্যাদি চিন্তায় এনে সবসময় ক্যালরিসম্পন্ন পুষ্টিকর খাবার শিশুকে জোগানো হচ্ছে কি না সে বিষয়টির প্রতি মা-বাবাকে মনোযোগী হতে হবে। ঠিক কতটা পরিমাণ খাবার শিশু খাবে সেটি তার দায়িত্ব, সে নিজে তা নিয়ন্ত্রণ করুক। একজন শিশু সাধারণত তার শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খিদে থাকা, না থাকার উপর নির্ভর করে খাবার পরিমাণ নির্ধারণ করে। কোনো শিশুর দৈনিক আহারের পরিমাণে বেশ বড় রকমের গরমিল লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু পুরো সপ্তাহ মিলে তার গোটা খাবারের পরিমাণ প্রায়ই ঠিক থাকে। মা-বাবার উচিত যে সময়ে বা সপ্তাহের যে দিনগুলোতে সে খাবারে আগ্রহ দেখাচ্ছে, সে সময় উচ্চক্যালরিসম্পন্ন খাবার পরিবেশন করা, শিশুকে যখন তখন চিপস্, চকলেট, ড্রিংকস খেতে না দেয়া। শাকসবজি, ডাল, চাল, ডিম এসব খাবার একটু বেশি পরিমাণ সরিষা বা সয়াবিন দিয়ে রান্না করে শিশুর খাবার সহজেই উচ্চক্যালরিসম্পন্ন করা যায়। কিন্তু তা না করে সম্পর্ণ না বুঝে খাওয়ার জন্য মা-বাবা ও অভিভাবকদের অতিনিয়ন্ত্রণ ও বাড়াবাড়ি শিশুকে তার খাবার গ্রহণের প্রাকৃতিক নিয়মে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অভ্যস্ত হতে বাধা সৃষ্টি করে। তার ফল হয় মারাÍক। হয়তো শিশু মোটেও খেতে চায় না, মা-বাবা খাবারের প্লেট হাতে নেয়া মাত্র তা দেখে সে পেছনের দিকে সরে যেতে থাকে বা অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের কারণে স্থূল শরীরের অধিকারী হয়। শিশুর খাদ্য সম্পর্কিত কুসংস্কার শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। পুষ্টি চাহিদার কথা বিবেচনা না করে নানা রকম কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে প্রয়োজনীয় খাবার থেকে তাদের বঞ্চিত করে অপুষ্ট, দুর্বল, অসুস্থ শিশুতে পরিণত করা হয়। অনেক সময় দেখা যায়, এক বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত শিশুকে দুধ ছাড়া অন্য কোনও ধরনের খাবার দেয়া হয় না। মায়েরা মনে করেন সে অন্য কোনও খাবার হজম করতে পারবে না। আবার অনেকে শিশুকে ডাল খেতে দেন না, পেট খারাপ হবে বলে। এছাড়া অনেকে মনে করেন গুড়, চিনি, কলা, মিষ্টি আলু খেলে শিশুর কৃমি হবে। তাই এসব তাদের খেতে দেয়া হয় না। আসলে এসব খাবার থেকে কোনভাবেই কৃমি হয় না। ময়লা, নোংরা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ও অপরিষ্কার ময়লা হাতে শিশুদের খাওয়ালে শিশুরা কৃমি দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। কলা খাওয়ালে শিশুর ঠাণ্ডা এবং সর্দি লাগতে পারে, ডিম খেলে পেট খারাপ হতে পারে এরকম কথাও শোনা যায়। আবার অনেক সময় দেখা যায় শিশুদের পেটের অসুখ হলে শুধু ডাবের পানি বা বার্লি খেতে দেয়া হয়। এগুলো সবই খাবার সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা। এ ধরনের কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা দূর করে শিশুদের সব ধরনের খাবার খাওয়াতে হবে।